রোজ পুকুর ধারে আসে স্টেলা.....
নরেনের কথামতো দোলনায় বসে দুলতে থাকে.....
শীতের সময় পুকুর ধারের এই গাছটাই লাল রঙের ফুল হয়...
তার বাড়ির ওই জানালা থেকে কি দারুন দেখতে লাগে তখন গাছটাকে......
আবার গরম পরলো...... কিন্তু নরেন এবারে আর এল না..... অস্থির হয়ে উঠল স্টেলা......
এখন তো আর তেমনভাবে পুরনো সেই ছেলে গুলো খেলতেও আসে না......
আর তার জায়গায় এসেছে নতুন কতগুলো ছেলে....
কাকে জিজ্ঞাসা করবে সে নরেনের কথা.....
পরের বছর গরমের ছুটি ও কেটে গেল.....
এভাবে কেটে গেল কয়েকটি বছর...... নরেন আর এল না..........
এতদিন ধরে রোদে পুড়ে.. বৃষ্টিতে ভিজে নড়বড়ে হয়ে উঠেছে দোলনাটা ও......
তাতে আর দোল খায় না সে.......
বসে থাকে পুকুরপাড়ে......
10 বছর কেটে গেছে এমন করেই......
একদিন সন্ধ্যে হতেই যায়......
একলা বসে আছে স্টেলা পুকুর পাড়ে.....
হঠাৎ করেই পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে একটা ছেলে তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসছে....... মুখ ফিরিয়ে নিল স্টেলা.......
তার কিছুক্ষণ পর আবার মুখ ফিরিয়ে একই দৃশ্য দেখল......
কিন্তু এবার ভাল করে তাকিয়ে দেখল ছেলেটিকে......
ছেলেটি আর কেউ নয় সে যে নরেন....
স্টেলার মন খুশিতে ভরে উঠল.....
দশ বছর অপেক্ষার পর দেখছে নরেনকে.....
নরেন কত বদলে গেছে.........
সেই সাদামাটা পোশাক এখন আর নেই তার বদলে রয়েছে চকচকে পরিষ্কার পোশাক...
হাতে সোনার চেন দেওয়া ঘড়ি.....
পায়ে জুতো......
- কত বদলে গেছো তুমি নরেন.....
এখন তো চেনাই যাচ্ছে না তোমাকে.....
আমি তো তোমায় চিনতেই পারিনি......
নরেন হাসলো, তারপর বললো
- কিন্তু তুমি একই আছো.....
সেই আগের মতো.....
শুধু একটু বড় হয়ে গেছো তাই না স্টেলা.....
নরেনের প্রশ্নের উত্তরে হেসে উঠল স্টেলা.....
তারপর বলল
- যখন তোমার সাথে দেখা হবে তখন তুমি যদি আমায়
চিনতে না পারো......
তাই বদল করিনি কিছু...... একই রকম আছি...
স্টেলারর পাশে গিয়ে বসলো নরেন.....
হঠাৎ করেই যেন শিহরন বয়ে গেল স্টেলার শরীরে.......
তারপর অনেক্ষণ ধরে সবই নিস্তব্ধ......
কী একটা কথা যেন বলতে গিয়ে নরেনের দিকে তাকিয়ে থেমে গেল স্টেলা..
নরেন অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে.....
মুখ নীচু করে বসে রইলো সে........
তা দেখে চোখ ফিরিয়ে নিলো নরেন......
তারপর বললো
- দোলনা ছেড়ে মাটিতে বসেছো যে বিদেশী
রাজকুমারী......
- রাজকুমারী সিংহাসন যে বড় নড়বড়ে হয়ে উঠেছে 10
বছরে সে খেয়াল কি রয়েছে....
অভিমানের সুরে বললো স্টেলা.....
- ঠিক আছে রাজকুমারী আপনার সিংহাসন আবার
নতুন করে তৈরি করে দিয়ে যাব এবার.....
- হুম তারপর আবার 10 বছর আমাকে অপেক্ষা
করাবে.....
আমার কোনো খবর নেবে না এই মতলব ভেবেছ
বুঝি.....
বলেই দুজনেই হেসে ফেললো......
- জানো নরেন আমার পোষা খরগোশটা মরে গিয়েছে...
বলেই কেঁদে ফেললো স্টেলা.....
এক্ষেত্রে বিদেশী হোক বা দেশের মেয়ে..... এরা সবাই এক.....
কখন যে হাসে আর কখন কাঁদে কেউ জানে না.....
এভাবে কাটলো সপ্তাহ খানেক.....
পুরনো দোলনার বদলে এসেছে নতুন দোলনা.....
এই কদিন কীভাবে কেটে গেল বুঝতেই পারেনি স্টেলা.......
তার পরে এলো আবার নরেনের বিদায় নেবার পালা.......
এবার কিন্তু আর কাঁদলো না স্টেলা......
দশ বছর অপেক্ষা করে এখন অপেক্ষা করতে শিখে গেছে সে.....
কাল নরেন বাড়ি ফিরবে.....
নরেন এসে পাশে বসলো স্টেলার.....
কিন্তু দুজনের কেউই কোনো কথা বললো না.....
যেন কারোর মুখ থেকে কোন কথা আসে না.....
সন্ধ্যে হয়ে এলো দেখে উঠে দাঁড়ালো স্টেলা.....
বললো
- এবার আমি আসি নরেন....
ভালো থেকো..... সময় পেলে আবার এসো......
আমি তোমার অপেক্ষায় থাকবো......
নরেন শুধু একটা হুম দিয়ে শেষ করলো......
পিছন ফিরে এক পা বাড়িয়েছে স্টেলা...
এমন সময় তার হাতটা ধরলো নরেন বললো
- আর একটু বসো না আমার পাশে....
স্টেলার হাত ধরে নিয়ে এসে বসালো নিজের পাশে......
স্টেলার মনে পড়ল সেই প্রথম দিনের কথা.....
সেদিনও এমনি করেই তার হাত ধরে তাকে খেলতে নিয়ে গিয়েছিল নরেন.......
অনেকক্ষণ আবার সব নিস্তব্ধ.......
কিছুক্ষণ পর নিরবতার দরজা ভেঙে বলে উঠল স্টেলা
- এবার যেতে হবে সন্ধ্যে হয়ে গেছে.......
নরেন ডাকলো......
স্টেলা সাড়া দিল কিন্তু নরেন কিছুই বলতে পারল না......
অনেকক্ষণ পর স্টেলা বললো
- সময় যে বয়ে যায় নরেন..
তুমি কি কিছু বলবে আমায়???
- কই না তো
বলে উঠল নরেন......
- তবে আমি যাই.....
- না যেও না..
বোসো কথা আছে আমার.......
দুজন বসে রইল চুপ করে.......
চারিদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে....
পাখিরা বাসায় ফিরেছে...... গাছের তলা নিস্তব্ধ......
চারিদিকে জোনাকি ডাকতে শুরু করেছে.....
মৃদুমন্দ বাতাস বইছে.......
পলাশ ফুলের পাপড়ি ঝরে পড়ছে.......
দূরে কোথাও যেন একবার কোকিল ডেকে উঠলো..........
- সন্ধ্যে হয়ে গেছে আসি নরেন.....
এই বলে উঠে দাঁড়ালো স্টেলা.....
স্টেলার হাতটা ধরে উঠে দাঁড়ালো নরেন ও.....
তারপর বললো
- চলো যাই........
এক পা বাড়িয়ে থমকে দাঁড়ালো নরেন..... তারপর বলল
- আচ্ছা আমরা কি দূরে অনেক দূরে কোথাও চলে
যেতে পারি না.....
যেখানে তোমার বাবা থাকবে না....
থাকবে না আমার বাবা.....
আর তার বিশাল জমিদারি......
শুধু তুমি আর আমি........
এ কথা শুনে শিউরে উঠলো স্টেলা......
তার গায়ে যেন একটা বিদ্যুত খেলে গেলো.....
পরিষ্কার বুঝতে পারলো নরেন কিন্তু কিছু বললো না......... তারপর বললো
- চলো বাড়ি যাই সন্ধ্যে হয়ে গেছে......
নরেনের হাত ধরে নিস্তব্ধ মাঠ ধরে, এক আকাশ ভরা জোৎস্নার মাঝ দিয়ে হেঁটে যেতে খুব ভালো লাগলো স্টেলার.......
আজ মনে হল সে যেন দুনিয়ার সব থেকে বেশি খুশি........
দুনিয়ার সব খুশি বুঝি আজ ভগবান তার দরজায় উজার করে নিয়ে এসে হাজির করেছে......
পৃথিবীটা নতুন রঙ নিয়ে সেজে উঠেছে আজ শুধু তাদেরই জন্য......
বাড়ির সামনে এসে দাড়ালো দুজন......
- এবার বাড়ি যাও স্টেলা.....
স্টেলার চোখ জলে ভরে গেল......
- আবার কবে দেখা পাবো তোমার?????
নরেন নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে উত্তর দিলো
- জানিনা......
তবে যতদিন তোমার ও মুখ ভুলে থাকতে পারবো,
ততদিন আর আসবো না এদিকে....
একথা বলেই চুপ করে গেল নরেন......
গলা ভারী হয়ে এলো তার......
স্টেলার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো..
নরেন যত্ন করে সে জল মুছে দিয়ে বললো
- আজ তোমায় দারুন দেখাচ্ছে স্টেলা????
এতদিন খেয়ালই করিনি তুমি কত সুন্দর....!!!
আর এমন সুন্দর মুখে কি চোখের জল
মানায়....
কেঁদোনা স্টেলা......
আমি আবার আসবো.....
তোমার ওই চোখ আর এমন সুন্দর মুখখানি ভুলে কি
থাকা যায়.....
এবার বাড়ি যাও.....
স্টেলা পা বাড়ালো বাড়ির দিকে....
যতক্ষণ না বাড়িতে দরজায় কড়া নাড়লো স্টেলা ততক্ষণ নরেন দাঁড়িয়ে রইল ওইখানে......
তারপর চলে গেল ধীরে ধীরে...........


No comments:
Post a Comment