এভাবেই কেটে গেল আরো মাস দুয়েক.....
এতদিন ধরে এই খেলতে আসা ছেলেগুলোর প্রায় সবাইকেই চিনে গেছে সে.....
তারা কখন কি খেলে.... কি করে.... সব এখন বুঝতে পারে স্টেলা........
আজ রবিবার তাই স্কুল ছুটি.......
আজ সকাল থেকেই মেঘলা করে আছে আকাশটা.......
আজ তার বাবা-মা যাচ্ছেন কোন এক জায়গায় কারোর বাড়িতে নিমন্ত্রণ আছে......
স্টেলা যেতে চাইলো না.....
তাই তার বাবা-মা বাধ্য হয়েই তাকে একলা রেখে গেছেন......
তাই আজ সে দুপুরের খাওয়াটা একটু সকাল করেই সেরে নিয়েছে.......
এরপর বিছানায় এসে একটা গল্পের বই নিয়ে শুয়ে পড়ল স্টেলা......
বৃষ্টি নেমেছে বেশ জোরে.....
মন দিয়ে গল্পের বই পড়ছিল............
এমন সময় মাঠের জানালাটার দিক থেকে শব্দ আসায় বই ফেলে জানলায় এসে দাঁড়ালো স্টেলা.....
দেখলো বাইরে বৃষ্টি নেমেছে ঝমঝমিয়ে.....
আর তার মধ্যে সেই বৃষ্টিতে ভিজে মাঠে খেলছে সেই ছেলে গুলো......
কাদায় পড়ে...... বৃষ্টিতে ভিজে খুব মজা করছে তারা.......
আবার কখনো বা পুকুরের ধারে থাকা গাছের ডাল থেকে ঝাঁপ দিচ্ছে পুকুরে......
এ সমস্ত কান্ড হাসিমুখে দেখতে দেখতে তার চোখে পড়লো..... ওদের দলে আজ নতুন একটা ছেলে এসেছে......
এই দুই মাস আগে তাকে দেখেনি কখনো........
ওদের দেখেই বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করলো স্টেলার ও......
বাবা মাও তো আজ নেই বাড়িতে.......
এ কথা মনে পড়ে যেতেই জানলা থেকে সোজা দৌড় দিলো বাগানে.......
তারপর এক পা এক পা করে এগোতে এগোতে এসে দাঁড়ালো খেলার মাঠের সামনে......
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের খেলা দেখতে থাকলো স্টেলা........
প্রথমবার বৃষ্টিতে ভিজতে পেয়েছে সে......
দারুণ আনন্দ হল স্টেলার......
মাঠের নতুন ছেলেটি এসে দাঁড়ালো স্টেলার সামনে...... সে কিছু একটা বলছে কিন্তু স্টেলা বুঝতে পারল না.... তাই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল সে...... তখন ছেলেটি স্টেলার হাত ধরে তাকে নিয়ে গেল ওই সবুজ মাঠে....... যেখানে সবাই খেলছে.......
স্টেলা কে দেখে সবাই খেলা থামিয়ে দিল......
সাদা চেহারার কাউকে দেখলেই ভয় পেয়ে যায় কালো চামড়ার এই ছোট্ট ছেলে গুলো......
নতুন ছেলেটি সবাইকে কি যেন বলল..... তাতে সবাই যেন মনে হল কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছে.......
আবার খেলতে লাগলো সবাই মিলে.....
ওকে নিয়ে খেলতে লাগল সকলে.....
তার বেশ ভালো লাগছিলো খেলতে.......
কিছুক্ষণ পর স্টেলার বাড়ীর কাজের মেয়েটা স্টেলাকে খুঁজতে খুঁজতে মাঠে এসে হাজির হলো......
আর শত আপত্তি করলেও স্টেলাকে নিয়ে গেল.....
এরপর দুদিন পর্যন্ত আর কিচ্ছু জানেনা স্টেলা....
বৃষ্টিতে ভেজায় খুব জ্বর হয়েছিল তার.........
এখন একটু সুস্থ হলেও ওঠার ক্ষমতা নেই শরীরে.....
বিকেল হলো দেখে কোনমতে বিছানা ছেড়ে উঠে জানলার পাশে থাকা চেয়ারটায় বসলো সে......
এখনো খেলতে আসেনি কেউ.....
স্টেলার মনে পড়ল সেই নতুন ছেলেটার কথা.... আনমনে চেয়ারে বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখলো নতুন ছেলেটি তার বাড়ির চারিদিকে ঘুরে ঘুরে কি যেন দেখছে.......
যেন কাউকে খুঁজছে সে.....
অথচ মাঠে তো এখনো কেউ খেলতে আসেনি....
স্টেলা ডাকলো তাকে..... কিন্তু তার আওয়াজ খুবই ক্ষীন..... তাই শুনতে পেল না ছেলেটি.....
এই ৩ দিনের জ্বর কাবু করে ফেলছে তাকে....
তাই টানা ৫ দিন পর একটু সুস্থ হয়ে, মাকে কোনরকমে রাজি করিয়ে মাঠে এসে দাঁড়ালো স্টেলা......
স্টেলাকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে এলো ছেলেটি....
তারপর ইংরেজি আর বাংলা মেশানো ভাষায় জিজ্ঞাসা করল সে
- শরীর খারাপ করেছিল নাকি?
তার ভাষা শুনে হেসে ফেলল স্টেলা......
তারপর উত্তর দিলো হ্যাঁ জ্বর হয়েছিল তার.....
তবে ইংরেজি কিছুটা বলতে পারে দেখে অবাক হলো স্টেলা......
ছেলেটি তাকে খেলতে ডাকলো কিন্তু স্টেলা যেতে চাইলো না......
সে এখনো দুর্বল.....
তাই ছেলেটি তাকে নিয়ে গিয়ে বসলো সেই গাছটার তলায়......
- আজ একটা নতুন খেলা খেলবো....
বললো ছেলেটা......
এরপর এক ছুটে একটা ছিপ নিয়ে এলো সে......
তারপর জলে ছিপ ফেলে বসে রইল দুজনে....
কত কথা হলো নরেন আর স্টেলার।.....
আজ স্টেলা জানলো এই ছেলেটির নাম নরেন.....
দুজনের বেশ ভাব হয়ে গেল কদিনের মধ্যে.....
দুজন দুজনকে বাংলা আর ইংরেজি শেখাতে লাগলো........
এখন রোজই মাঠে আসে স্টেলা..... তবে একটু দেরি করে.........
একদম বিকেল হলে তবেই বাড়ি থেকে ছাড়ে তাকে......
নরেন অনেক আগে থেকে এসে ওই পুকুর পাড়ে অপেক্ষা করে...
এভাবেই কাটছিল তাদের দিন.....
সেদিনও এমনি বিকেলে মাঠে এল স্টেলা......
কিন্তু আজ নরেন নেই দেখে অবাক হল সে.........
তারপর অনেকক্ষণ পুকুর ধারে বসে অপেক্ষা করলো.....
অনেক সময় গেল কিন্তু নরেন এলো না......
মন খারাপ করে বাড়ি চলে গেল স্টেলা.....
তারপর থেকে বহুদিন হয়ে গেল নরেন আর খেলতে আসে না.......
বিকেলের দিকটায় ঘরে মন বসেনা স্টেলার......
গল্পের বই ও ভালো লাগে না তার......
আর তাই পোসা খরগোশ কোলে নিয়ে বাগানে ঘুরে বেড়ায়.........
এবছর গরম পড়েছে বেশ ভালই......
ঘর থেকে বাইরে বেরোনো যায় না......
তাই এখন প্রায় সন্ধ্যের আগে বাগানে আসে স্টেলা.......
সেদিন এমনি এক বিকেলে.... সন্ধে তখন প্রায় হতে যায়..... এমন সময় বাগানে এলো স্টেলা.....
মাঠের দিকটায় একবার চোখ ফেরাতেই দেখল গাছের তলায় বসে আছে একটা ছেলে ছিপ নিয়ে.......
হাসি ফুটে উঠলো স্টেলার মুখে.....
খরগোশ কোলে নিয়েই ছুটলো স্টেলা পুকুরের দিকে.....
একদম গিয়ে থামল নরেনের পিছনে......
হাসিমুখে ফিরে চাইল নরেন.......
তখনো হাপাচ্ছে স্টেলা........
বসলো গিয়ে নরেনের পাশে.......
তারপর পরিষ্কার বাংলা ভাষায় বললো
- কেমন আছো নরেন?
নরেন প্রথমে কিছুটা অবাক হলো তার স্পষ্ট বাংলা শুনে......
তারপর হেসে ফেললো......
- কি হাসছো যে?
আমার প্রশ্নের উত্তর দিলে না তো?
তখন স্পষ্ট ইংরেজি উচ্চারণ এর উত্তর দিলো নরেন
- ভালো আছি......
এবার স্টেলা ও হেসে ফেললো.......
বুঝল তারা দুজনেই এতদিন ধরে চেষ্টা করে একে অপরের ভাষা শিখেছে বড় যত্ন করেস্টে.....
স্টেলার খুব রাগ হয়েছিলো..... তাই অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে বললো
- এতদিন কোথায় ছিলে?
আমি তোমার জন্য কত অপেক্ষা করেছি......
- তাই বুঝি......
বলেই হেসে ফেলল নরেন..
রেগে গিয়ে কেঁদে ফেলল স্টেলা....
- আহা কাঁদো কেনো?
বলে চোখের জল মুছিয়ে দিলো নরেন......
- বলোতো এত সুন্দর দুই চোখে জল কি মানায়.....!
আমি বাড়ি গিয়েছিলাম.....
এখানে আমার মামার বাড়ি......
তাই গরমের ছুটিতে আমি মামা বাড়ি আসি......
মা মারা যাবার পর থেকে মামার বাড়িতেই থাকতাম
প্রথমে....
পরে একদিন বাবা এসে জোর করে আমায় নিয়ে যায়.....
সেদিন অনেক কেঁদেছিলাম..
তবুও বাবা জোর করে নিয়ে যায়.....
নতুন মায়ের একটা মেয়ে হয়েছিলো....
তাই বাবার বিশাল জমিদারি..... আর জমিদারিতে বাতি দেবার জন্য একমাত্র আমিই আছি...
তাই আমায় নিয়ে যায় বাবা....
তাই এখন কেবল ছুটি পড়লে তবেই আসতে পাই......
নরেনের বুকে যেন একরাশ কষ্ট চেপে রয়েছে......
কথা ঘোরানোর জন্য স্টেলা অন্য কথা তুললো.....
গরমের ছুটি প্রায় শেষ হতে চললো......
নরেনের বাড়ি ফেরার দিন এগিয়ে এলো.....
স্টেলার মুখভার......
তাই একদিন দুপুর থেকে এসে সেই গাছের ডালে একটা দোলনা বানালো নরেন...
তারপর বিকেলে স্টেলা এলো....
সেই দোলনায় স্টেলা কে দোলাতে দোলাতে নরেন বললো
- এবার আমি যতদিন না আসি ততদিন তুমি এই
দোলনায় দুলে সময় কাটিয়ো কেমন..
স্টেলার চোখ জলে ভরে উঠলো.....
জল মুছিয়ে তাকে দোলাতে দোলাতে গান গাইলো
" আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী "
বাড়ি ফিরে গেল নরেন..
শুরু হলো আবার দীর্ঘ প্রতীক্ষা......

No comments:
Post a Comment