Wednesday, April 24, 2019

ওগো বিদেশিনী পর্ব - ৫





বছর দেড়েকের ও বেশি সময় কেটে গেছে...
তাও আজও বোধহয় নরেনের স্টেলার মুখটা মনে পড়েনি.....
আর থাকতে পারলো না স্টেলা...


সেদিন সকাল থেকেই স্টেলার কেন জানি না খুব মন খারাপ করছে নরেনের জন্য.....
সেদিন সে প্রথমবারের জন্য নরেনের মামার বাড়ির খোঁজে বেরোলো...

সারাদিন রোদে ঘুরে ক্লান্ত স্টেলার মুখটা শুকিয়ে উঠেছে.... তবুও মামার বাড়ির খোঁজ পেল না সে.....
যখন সব পথই প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে তখন নিরাশ হয়ে বাড়ি ফিরছিল স্টেলা.......
এমন সময় একটা ছেলের কাছ থেকে পেলো নরেনের মামার বাড়ির খোঁজ.....
ভর দুপুরের রোদ মাথায় নিয়ে ক্লান্ত স্টেলা এসে পৌছালো নরেনের দিদার কাছে......
দিদা সবই জানতো.....
তবে এর আগে তিনি স্টেলা কে কখনো দেখেনি....
নরেন কতবার দিদাকে স্টেলার গল্প করেছে..............
এর আগে বৃদ্ধা স্টেলা কে দেখিনি কখনো তবুও যেন তাকে চিনতে পারল বৃদ্ধা...... বললো

- তুমি সেই বিদেশিনী তাই না ?
  এখন এসো বাছা বসো এখানে......
  রোদে পুড়ে যে মুখখানি লাল হয়ে গেছে.....
  এখানে বসে জিরিয়ে নাও কতক......
   তারপর বাড়ি ফেরো..........

এই বলে জল আনতে চলে গেল বৃদ্ধা.......
জল নিয়ে ফিরে এলো বৃদ্ধা....
স্টেলা জিজ্ঞাসা করায় বৃদ্ধা জানালো নরেনের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে সামনেই......
 প্রথমে সে মত দেয়নি......
পরে বাবার চাপের মুখে পড়ে বাধ্য হয়ে বিয়েতে মত দিয়েছে নরেন......
স্টেলার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো.....
বৃদ্ধা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে......
বৃদ্ধার চোখে চোখ পড়তেই চোখের জল মুছে ফেললো সে......
তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বিদায় নিল বৃদ্ধার কাছ থেকে.........
আজ যেন তার পা চলছে না......
সেদিনও এমনই এক সন্ধ্যে ছিল যেদিন নরেনের হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে নিজেকে দুনিয়ার সব থেকে বেশি সুখী বলে চিহ্নিত করেছিলো সে.....
আজও এমনই এক সন্ধ্যে.....
কিন্তু আজ আর সে দাবি নেই তার........


বাড়ি ফিরে শুয়ে পড়ল সে......
সেদিনের পর থেকে আর মাঠের ওই পুকুর ধারে যায়নি সে.......
বিকেলে শুধু বাগানে আসে একবার করে...
কি যেন একটা আশায় খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে বেশ কয়েক দিন...

 এভাবে প্রায় সপ্তাহখানেক কেটে গেল....


একদিন বিকেলে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো স্টেলা প্রতি দিনের মতন বাগানে আসবার জন্য... কিন্তু গায়ে যেন শক্তি ফুরিয়ে আসছে......
পরিচারিকার সহায়তায় বাগানে এসে বসলো সে..............
সন্ধ্যে তখন প্রায় হয়ে আসছে......
এমন সময় দেখলো তাদের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে নরেন.....
উঠে দাঁড়ালো সে......
এই কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত যার উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতাটুকুও ছিল না সে কারো সাহায্য ছাড়াই উঠে দাঁড়িয়ে হেঁটে গেলো নরেন এর কাছে.......
তারপর দুজনে গিয়ে বসলো সেই পুকুর পাড়ে......


আজ নিজে থেকেই নরেনের হাত ধরেছে স্টেলা..... নরেন দুবার হাত ছাড়িয়ে নিল......
একরকম জোর করেই ধরেছে সে.....
নরেন বললো

- নিজের কি অবস্থা করেছো...
  কত রোগা হয়ে গেছো.......
  চোখের তলায় কালি পড়েছে.....
  এমন সোনার বরণ রং..... অমন চোখ যেন কোথায়
   হারিয়ে গেছে...

 হাসলো স্টেলা..

 নরেন বললো

- হাসল যে বড়ো???

- যে রং, মুখমণ্ডল আর চোখ তোমার মনে পড়েনা
  তাকে রেখেই বা লাভ কি...

 চুপ করে গেল নরেন তারপর বললো

- পরে স্টেলা......
 প্রতিনিয়তই মনে পরে...
  ছুটে আসতে ইচ্ছে করে তোমার কাছে....

- তবুও তো একদিনও এলে না নরেন..

- আমি নিরুপায় ছিলাম...
  জানো মাঝে মাঝে মনে হয় যন্ত্রের মত হয়ে গেছি
  আমি....
  সারাদিন শত কাজে ব্যস্ত রাখি নিজেকে শুধু তোমায়
  ভোলার জন্য...
  কিন্তু রাতে আর পারি না.....
  চোখ বন্ধ করলেই তুমি এসে দাঁড়াও আমার সামনে....

  চলো না দুজনে যাই অনেক দূরে.....
  যেখানে কেউ থাকবে না.....
  থাকবেনা তোমার বাবা....
   থাকবে না আমার বাবা.....

বলেই আকুল হয়ে কেঁদে ফেললো স্টেলা...

 - তা আর সম্ভব নয় ...
   আমি বাবাকে কথা দিয়ে এসেছি..
  এই শেষবারের জন্য আমার এখানে আসা.....

নিজেকে সামলে নিলো স্টেলা....
চোখের জল আজ নিজেই মুছে নিয়ে তারপর হাসি মুখে জিজ্ঞাসা করলো

- তা বউ দেখতে কেমন নরেন?
  খুব সুন্দরী নিশ্চয়ই...

- জানিনা ....

- ওমা ওকি কথা....
   নিজের হবু বউকে এখনো দেখনি বুঝি...

 - না দেখি নি....

কথাটা যেন গভীর আর্তনাদের মতো করে বেজে উঠল স্টেলার কানে....
চুপ করে গেলো সে ....

তারপর বহু কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে নরেন বললো

- আমায় ভুলে যাও......
  নতুন জীবন শুরু কর....

এই বলে চুপ করলো নরেন....
শেষের কথাগুলো জড়িয়ে গেল তার....
চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল একটি শুভ্র অশ্রুকণা..... সযত্নে মুঝে দিল সে জল....
তারপর বললো

- আর কষ্ট পেয়ো না......
 দেখো আমি ঠিক আছি......
  তুমি নিজেকে আর দোষী করোনা....
  সমস্ত অদৃশ্য বন্ধন থেকে আজ তোমায় মুক্তি
  দিলাম......
  ভালো থেকো..........

এই বলেই উঠে দাঁড়ালো স্টেলা.......
তারপর বাড়ীর দিকে পা বাড়ালো....
একদিন এমন সময় এই রাস্তায় হেঁটে ছিল সে নরেনের হাত ধরে.......
 কিন্তু আজ সে বড় একা.......


 নরেন অনেকক্ষণ বসে রইলো ওইখানে.....
তারপর হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির দিকে রওনা দিল সে.........
সকাল বেলা নরেন যখন বাড়ি এলো তখন তাকে দেখে মনে হল যেন মামলায় সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে বাড়ি ফিরেছে সে........
চুল এলোমেলো..... চোখে সারা রাত ঘুম নেই.... শরীর ক্লান্ত অবসন্ন......

তার অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গেলো তার ঠাকুমা.... তারপর ঠাকুমাকে শান্ত করে বিছানায় শুয়ে পড়ল নরেন......
এরপর বালিশে যে কত অশ্রু গড়িয়ে পড়ল তার হিসাব নিল না কেউ.....
কেউ আর মুছিয়ে দিলো না.....
তার মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরতে থাকলো.....

    "সে আমায় সব বন্ধন থেকে মুক্তি দিয়েছে"



বিয়ের দিন এগিয়ে এলো.....
নরেন কেমন যেন এক অসম্ভব রকম শান্ত হয়ে রয়েছে........
তারপর বিয়ের দিন সকাল বেলা দরজা খুলছে না নরেন.....
সকলে মিলে দরজা ভেঙে দেখল নরেন বিছানায় শুয়ে আছে...... মুখে তার শান্ত এক হাসি.....

সকলকে মুক্তি দিয়ে চলে গেছে সে....
কারণটা এখন কোন বন্ধন নেই তার.... সে মুক্ত....


এরপর এক বছর কেটে গেছে.....
এ বছর কুড়ি তে পা দিলো স্টেলা.....
আজ তার জন্মদিন......
কিন্তু আজও বড় একলা সে.....
ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে ছাদে গিয়ে দাঁড়ালো স্টেলা......
খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আজ তার মনে পড়ে গেল বাবা মায়ের হাত ধরে শেষবারের জন্য ইংল্যান্ড থেকে জাহাজে পাড়ি দিয়ে আশার কথা তার পর মনে পড়লো সেই ছোট্টবেলার নরেন আর স্টেলা কি চোখ জলে ভরে উঠলো স্টিল আর এই আকাশ এই হাওয়া ঐ গাছ আর ঐ বিশাল মাঠ সবাইতো সাক্ষী ছিল সেই সন্ধ্যের সেদিন কথাটা বলতে চেয়ে ও বলতে পারিনি নরেন তারপর থেকে দুবছর কেটে গেছে এদিকে আর আসেনি নরেন আজ অস্ট্রেলিয়ার মুখটা ফুলে বেশ আছে সে কেনই বা ভুলে থাকবে না এখন তো নতুন বিয়ে করেছে সে তার তো একটা নতুন বউ আছে একথা ভেবে আর শিঁউরে উঠলো স্টিলাস বেশ কিছুদিন ধরে জ্বরে ভুগছে সে তাই আর ছাদে দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না এসে ঘরে এসে শুয়ে পড়ল বিছানায় সারাদিন কাঁদল কোনরকমে বাবা মা এর মুখে চিন্তার ছবি এখন বড় বড় ডাক্তার আসছে তাদের বাড়িতে কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না এভাবেই বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হল আর সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত নামলো রাতে সকলের অলক্ষ্যে ক্লান্ত অবসন্ন শরীরটাকে কোনরকমে টানতে টানতে নিয়ে স্টেলা এসে দাঁড়ালো পুকুর ধারে তারপর বসে বসে এসব কথা ভাবতে লাগলো সে গা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে জ্বরের ঘোরে দেখল নরিন এসে দাঁড়িয়েছে তার পিছনে ঠিক সেই সেনদের মতো তারপর এসে বসলো নরিন নরিন আমার যে খুব কষ্ট নরেন হেসে বলল আমি তো তাইতো আমি তাইতো এলাম তোমার কাছে তোমায় নিতে সত্যি বলছো তুমি নরেন হ্যাঁ স্টেলা আমি সত্যিই তোমায় নিতে এসেছি আমাকে ছাড়া কি দশা করেছো বানিয়েছো নিজের হাস লোস্ট এলাম কতকটা যেন শান্তি পেল সে কিন্তু তোমার বউ তার কি হবে আজ আমি সবার থেকে মুক্ত স্টেলা কারোর প্রতি কোনো দায়িত্ব নেই আমার এক শুধু তুমি আছো তুমি আমায় যতই মুক্ত করল যতই মুক্ত করো না কেন আমি আজও মুক্ত হতে পারিনি তোমার থেকে আলাদা হতে পারিনি তাই তোমার থেকে তাইতো তোমায় নিতে এরাম এতটা পথ তুমি একলা যেতে পারবে না কিন্তু আমি কিভাবে যাব আমি যে বড় ক্লান্ত নরিন তাতে কি আমি তো আছি স্টিলা এখন একটু শুয়ে পরো দেখি হাসিমুখে নয়নে নরেনের কোলে মাথা রাখলো স্টিলা তার সব কষ্ট যেনো জুড়িয়ে গেল আজ নরেন বলল এবার চোখ দুটো বন্ধ করে একটু ঘুমাও আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেই তারপর গুন গুন করে গান গাইতে লাগলো নরেন আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী সকাল হলো মেয়ের ঘরে নেই রেখে মা কাঁদতে কাঁদতে গেল স্টিল আর বাবার কাছে তারপর পুরো বাড়ি খুঁজেও পাওয়া গেল না শীলাকে সামনে বাড়ি আশেপাশে খুজে দেখতে দেখতে চোখে পড়ল সেই পুকুর ধারে গাছটির নিচে শুয়ে রয়েছে স্টেলা বাবা-মা ছুটতে ছুটতে এসে দেখল তাদের তাদের মেয়ে আর নেই চলে গেছে সে অনেক দূরে হাসিমুখে ধরণীর কোলে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে চির নিদ্রায় ঘুমিয়েছে স্টেলা আর এই মিলন মিলন এ সাক্ষী সাক্ষী থাক এই খেলার সবুজ মাঠ এই খোলা হাওয়া ওই পলাশ গাছ আর এই মৃদু হাওয়া..........

No comments:

Post a Comment